Header Ads

Organon

অর্গানন অফ মেডিসিন



 Christian Friedrich Samuel Hahnemann
(German: [ˈhaːnəman]; 10 April 1755 – 2 July 1843)
বাংলায়- স্যামুয়েল হ্যানিম্যান

১| চিকিৎসকের উদ্দেশ্যঃ
অর্গানন চিকিৎসকের ব্রত (Calling of the Physician) রুগ্ন-মানবজাতিকে আরোগ্যদান করতঃ স্বাস্থের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই চিকিৎসকের মহৎ ও একমাত্র লক্ষ্য।

পাদটীকাঃ ১। অভ্যন্তরীণ জৈবশক্তির বিশেষ কাজ কি, দেহের অদৃশ্য অভ্যন্তরে কিভাবে ব্যাধির সৃষ্টি হয়, সেই বিষয়ে ফাঁকা জল্পনা-কল্পনা যোগ করে তথাকথিত ব্যবস্থা পদ্ধতি রচনা করা চিকিৎসকের ব্রত নয়। (এইভাবে কত চিকিৎসক যে আজ পর্যন্ত শুধু উচ্চাকাঙ্খার বশবর্তী হয়ে তাদের মেধা ও সময় নষ্ট করেছেন তার ইয়ত্তা নেই)। একদিকে রুগ্নমানবজাতি আরোগ্যের আশায় বৃথাই ধুঁকিতে থাকবে, অন্যদিকে রোগের অদ্ভুত বৈচিত্রের ব্যাপারে অসংখ্য ব্যাখ্যা ও তার নিকটতম কারণ (যা চিরকালই অজ্ঞাত থাকবে) দুর্বোধ্য ভাষা ও অসার জটিল ব্যঞ্জনায় অজ্ঞ লোকেরা তাক্ খেয়ে যাবে- এটাও চিকিৎসকের কাম্য হতে পারে না। এই ধরনের পান্ডিত্যপূর্ণ কল্পনাবিলাসি (তত্ত্বমূলক চিকিৎসা পদ্ধতি বলে যার নামকরণ হয়েছে ও সেইজন্য বিশেষ বিশেষ অধ্যাপক পদবীসমূহের সৃষ্টি করা হয়েছে) আমরা অনেক দেখেছি। সময় অনেক চলে গেছে, চিকিৎসক বলে যাঁরা নিজেদের পরিচয় দেন, রোগ-ক্লিষ্ট মানব জাতিকে কেবল কথার দ্বারা প্রতারণা করতে এইবার তাঁরা থামুন। রোগমুক্তির সত্যিকার আশ্বাস নিয়ে এখনও একটু এগিয়ে আসুন।

২| আদর্শ আরোগ্যের শর্তসমূহ:  
আরোগ্যের চূড়ান্ত আদর্শ (Highest Ideal of Cure)
সত্বর, স্বাছন্দ ও স্থায়িভাবে স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনাই আরোগ্যের চূড়ান্ত আদর্শ। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে, সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য ও নির্দোষ উপায়ে সর্বতোভাবে ব্যাধিকে নির্মূল এবং ধ্বংস করাও সেই লক্ষ্যেরই অন্তর্ভূক্ত। সহজবোধ্য নীতিই হইবে এই চিকিৎসার ভিত্তি।

৩। চিকিৎসাকার্যে পারদর্শী হবার জন্য চিকিৎসকের গুণাবলী।
      
প্রকৃত চিকিৎসা-বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যরক্ষক
(True Physician and Preserver of Health)
(৩-৪ সূত্র)
রোগে অর্থাৎ প্রত্যেকটি রোগীর ক্ষেত্রে (রোগ সম্বন্ধে জ্ঞান, সংকেত) কি আরোগ্য করতে হবে তা যদি চিকিৎসক পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন, ঔষধের আরোগ্যকারী শক্তি কি (ঔষধের শক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান) তা যদি তিনি উত্তমরূপে জানেন, স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত মূলনীতি অনুসারে রোগীদের মধ্যে রোগ বলে যা নিঃসন্দেহে জানা গেছে তার উপযোগী করে ঔষধের আরোগ্যকারী শক্তিকে কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে তা যদি জ্ঞাত থাকেন, তবে নিশ্চয়ই আরোগ্যের সূত্রপাত হবে। ঔষধের কার্যকারিতা অনুযায়ী রোগের সর্বাপেক্ষা উপযোগী ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে (ঔষধ নির্বাচন, সূচিত ঔষধ)। ঔষধ প্রস্তুত করবার সঠিক পদ্ধতি কি এবং কি পরিমাণ ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে (যথাযথ মাত্রা), তাও জাতে হবে। মাত্রা পুনরায় প্রয়োগ করবার সঠিক সময় সম্বন্ধে জ্ঞান থাকতে হবে। সর্বোপরি প্রত্যেকটি রোগীর ক্ষেত্রে আরোগ্যের পথে যে সব প্রতিবন্ধকতা আছে তাদের কিভাবে দূর করে আরোগ্য স্থায়ী করতে হবে সেই বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা থাকা নিতান্ত প্রয়োজন। সম্যকভাবে এইসব অবগত থাকলে তাঁকেই যুক্তিবাদী চিকিৎসক বলা হয়। তিনিই আরোগ্যকলার প্রকৃত আরোগ্য বিধায়ক।

৪। প্রকৃত স্বাস্থ্য সংরক্ষক হিসেবে চিকিৎসক। 
মানব-স্বাস্থ্য বিকৃত করে রোগ উৎপাদনকারী অবস্থা সমুদয়কে অপসারিত করতঃ মানুষকে সুস্থ রাখবার উপায় যিনি অবগত আছেন, তিনিই স্বাস্থ্য-রক্ষক বলে পরিগণিত হতে পারেন।


৫। রোগ আরোগ্যের জন্য চিকিৎসককে রোগের উত্তেজক অথবা মোলিক কারণ সম্পর্কিত জ্ঞান থাকতে হবে। উত্তেজক ও মূলকারণসমূহ (exciting & Fundamental Causes)
অচির রোগের একান্ত সম্ভাব্য উত্তেজক কারণ এবং চির রোগের সমগ্র রোগীলিপির গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ লক্ষণসমূহ ব্যাধির মূলকারণ নির্ধারণে চিকিৎসককে সহায়তা করে। কোন একটি চির রোগ-বীজই (Chronic Miasm) সাধারণতঃ চির-রোগ উৎপত্তির কারণ। রোগ আরোগ্য করবার জন্য চিকিৎসককে এইসব জেনে নিতে হবে। এইগুলি অনুসন্ধান করবার সময় রোগীর শারীরিক গঠন (বিশেষতঃ চিররোগে), তাঁর নৈতিক ও বুদ্ধিগত চরিত্র, পেশা, জীবনযাপন পদ্ধতি, অভ্যাস, সামাজিক ও পারিবারিক সম্বন্ধ, বয়স, যৌন কার্যকলাপ প্রভৃতি নির্ণেয় বিষয়ের দিকে নিশ্চিতভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।

৬। চিকিৎসককে বুঝতে হবে যে, রোগ হচ্ছে কতকগুলো লক্ষণের সমষ্টি।        
লক্ষণ সমষ্টি
(Totality of Symptoms)
(৬-৮ সূত্র)
৬। সংস্কার-বর্জিত পর্যবেক্ষক অভিজ্ঞতায় অসমর্থিত অতীন্দ্রিয়* কল্পনাকে নিরর্থক বলে কৃত

নিশ্চয় হবে। বোধ শক্তি খুব প্রখর হলেও তিনি প্রতিটি রোগীর শরীর মনের সুস্থ্  অবস্থা হতে যে সকল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে (রুগ্ন অবস্থা, আকস্মিক দুর্ঘটনা, লক্ষণসমূহ) সেইগুলি বাহ্যিকভাবে ইন্দ্রিয়সমূহের দ্বারাই উপলব্ধি করবেন। তা ছাড়া (অতীন্দ্রিয়- অনুঃ সব কিছুই তিনি অগ্রাহ্য করবেন। অর্থাৎ পূর্বেকার সুস্থ অবস্থা হতে বর্তমান রুগ্নাবস্থায় স্বাস্থ্য-বিচ্যুতি সম্বন্ধে রোগী যা যা অনুভব করেন, পরিচর্যাকারীরা যা যা বলেন ও চিকিৎসক নিজে যা (ইন্দ্রিয় সাহায্যে- অনুঃ) পর্যবেক্ষণ করেন- তিনি শুধুমাত্র সেইগুলিই লক্ষ্য করবেন। এইসব বোধগম্য লক্ষণরাজীর মাধ্যমেই রোগের সমগ্র স্বরূপ প্রকাশিত হয়। এইগুলি মিলে রোগের (পাদটীকা-২ দেখুন) যথার্থ ও একমাত্র বোধগম্য প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়।

পাদটীকাঃ ২। তাই চিকিৎসকেরা রোগীর বিছানার কাছে বসে লক্ষণরাজীর দিকে মনোযোগ না দিয়ে এবং চিকিৎসার ব্যাপারে লক্ষণরাজীর দ্বারা পরিচালিত না হয়ে, রোগীর অদৃশ্য ও অজ্ঞাত শরীরের ভিতরকার রোগের অনুসন্ধান ও আবিষ্কারে কি করে প্রবৃত্ত হন, তা আমি বুঝতে পারি না। লক্ষণাবলীর দিকে বিশেষ মনোযোগ করেন এবং (অজ্ঞাত!) ঔষধের দ্বারা তা সুস্থ করে দিতে সচেষ্ট হন। এই ধরনের চিকিৎসা-পদ্ধতিকেই তাঁরা একমাত্র প্রকৃত ও যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা-বিধান বলে অভিহিত করেন।
      সুতরাং যে অশরীরী সত্তা, প্রাণশক্তি রোগের সৃষ্টি করে** তাকে যখন কখনও চোখে দেখা যায় না, তখন প্রকাশমান লক্ষণসমূহের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে রোগ-চরিত্র জানা কি যুক্তিসঙ্গত নয়? আরোগ্যসাধনের জন্য রুগ্নতাজ্ঞাপক লক্ষণসমূহকে জানা দরকার। এটাকে দেখবার কোন প্রয়োজন নেই। প্রাচীনপন্থি চিকিৎসকগণ রোগীর দেহের ভিতরে সুপ্ত রোগের মূল কারণ (Prima causa morbi) সম্বন্ধে এমন কি খুঁজে বাহির করতে পারেন যার দ্বারা তাঁরা রোগের এমন প্রকাশমান ও বোধগম্য প্রতিকৃতিকে ঘৃণার সাথে অবজ্ঞা করতে পারেন? এইগুলি (লক্ষণসমূহ- অনুঃ) ছাড়া রোগের আর কি আরোগ্য করবার ইচ্ছা তাঁর পোষণ করেন ?

৭। লক্ষণসমষ্টিই উপযুক্ত ঔষধ নির্বাচনের একমাত্র নির্দেশিকা।           
সুতরাং যখন রোগের কোন স্পষ্ট উত্তেজক বা পরিপোষক কারণ (causa occasionalis) সরাতে (পাদটীকা-৩ দেখুন) হয় না তখন আমরা রুগ্ন লক্ষণসমূহ ছাড়া আর কিছুই উপলব্ধি করতে পারি না। কাজেই, আরোগ্য-বিধানের জন্য যে উপযোগী ঔষধের প্রয়োজন এইরূপ ক্ষেত্রে একমাত্র লক্ষণরাজীর দ্বারাই তা নিশ্চিতভাবে  [কোন সম্ভাব্য রোগ-বীজের (সরধংস) অস্তিত্ব সম্বন্ধে বিচেনা করে ও আনুষঙ্গিক অবার দিকে মনোযোগ দিয়ে- ৫ম সূত্র] নির্বাচিত হয়ে থাকে। অধিকন্ত, এই লক্ষণ-সমষ্টিই অভ্যন্তরীণ মূল ব্যাধির বাহ্যিক বিকাশ, অর্থাৎ জৈবশক্তিকে প্রভাবিত করে। এরাই ঔষধ নির্বাচনের প্রধান ও একমাত্র অবলম্বন। একমাত্র এদের মাধ্যমেই ঔষধ নির্বাচিত হয়ে থাকে। এক কথায়, লক্ষণ-সমষ্টিই (পাদটীকা-৪ দেখুন) প্রধান ও বাস্তবিক পক্ষে একমাত্র অবলম্বন। এটার সাহায্যেই চিকিৎসক তাঁর চিকিৎসা দ্বারা রোগীকে সুস্থ্য করবেন ও স্বস্থ্য রূপান্তরিত করবেন।

পাদটীকাঃ ৩। অভিজ্ঞ চিকিৎসককে প্রথমে এটা সরাতে হবে- এই কথা বলবার কোন প্রয়োজন নেই। তা হলেই অসুস্থতা স্বতঃস্ফূতভাবেই অপসারিত হবে। মূর্ছা ও হিস্টিরিয়া রোগের প্রবণতা সৃষ্টিকারী তীব্রগন্ধযুক্ত ফুল তিনি ঘর হতে সরিয়ে দিবেন। চোখের স্বচ্ছ ত্বকে প্রবেশ করে প্রদাহের সৃষ্টিকারী তীব্রগন্ধযুক্ত ফুল তিনি ঘর হতে সরিয়ে দিবেন। চোখের স্বচ্ছ ত্বকে প্রবেশ করে প্রদাহের সৃষ্টিকারী বাহিরের জিনিস তুলে দিবেন। জোরে বাঁধা ব্যান্ডেজ আহত স্থানে পচনক্রিয়া সৃষ্টি করে, কাজেই তিনি উহা ঢিলা করে উপযুক্ত ব্যান্ডেজের ব্যবস্থা করবেন। রোগী সংজ্ঞা হারাতে পারে এইরূপ বিক্ষত ধমনী বের করে তা বেঁধে দিতে হবে। বেলাডোনার ফল প্রভৃতি খেয়ে থাকলে তা বমি করিয়ে বের করে দিতে চেষ্টা করতে হবে। বাইরের কোন পদার্থ শরীরের কোন ছিদ্রপথে (নাসিকা, খাদ্যনলী, প্রস্রাবদ্বার, গুহ্যদ্বার, যোনিদ্বার) প্রবেশ করলে তা বের করে ফেলতে হবে। মূত্রাশয়ের পাথর চূর্ণ করে দিতে হবে। নবজাত শিশুর ছিদ্র-বিহীন মলদ্বার উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এইভাবে অন্যান্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও করতে হবে।
পাদটীকাঃ ৪। রোগীকে উপশম দিবার কৌশল আয়ত্তে না থাকায় প্রাচীনপন্থি চিকিৎসকেরা সব সময়ে বিক্ষিপ্ত রকমারী লক্ষণরাজী হতে একটি মাত্র লক্ষণ নিয়ে তাকে রোধ করতে বা সম্ভব হলে চাপা দিতে সচেষ্ট হন। এই একদেশদর্শী পদ্ধতি লাক্ষনিক চিকিৎসা নামে প্রচলিত হলেও এটা বিশ্ববাসীর নিকট ন্যায় সংগত ভাবেই অবজ্ঞাত হয়েছে। কারণ, এই প্রথাতে লাভ তো কিছুই হয়নি, বরং প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এক পা-বিশিষ্ট যেমন একটি মানুষ হয় না, একটিমাত্র লক্ষণেও একটি রোগ হতে পারে না। বিরুদ্ধ-ধর্মী ঔষধের দ্বারা (সুতরাং বি-সদৃশ ও উপশমদায়ক উপায়ে) একটিমাত্র লক্ষণের চিকিৎসা করবার ফলে সামান্য মাত্র উপশমের পর রোগীর অবস্থা আরও সাংঘাতিক হয়ে পড়ে। কাজেই এই পদ্ধতি আরও বেশি নিন্দনীয়।

৮। লক্ষণসমষ্টি দূর হলেই আরোগ্য লাভ হয়।   
রোগের লক্ষণসমূহ এবং উক্ত রোগে অনুভূত ঘটনাসমূহ দূর হলেই স্বাস্থ্য ছাড়া আর কিছুই থাকতে পারে না। কিংবা আভ্যন্তরীণ রোগজ পরিবর্তনগুলিও যে নির্মূল না হয়ে বর্তমান থাকে তা আমাদের ধারণার বাইরে বা এটা কোন পার্র্থিব পরীক্ষা দ্বারা ধরাও পড়ে না। (পাদটীকা-৫ দেখুন)
পাদটীকাঃ ৫। প্রকৃত চিকিৎসা-বিজ্ঞানী কোন রোগীকে আরোগ্য করবার পর সেই রোগীতে লেশমাত্র রোগলক্ষণ অবশিষ্ট থাকে না। তখন স্বাস্থের স্বাভাবিক অবস্থা স্থায়ি ভাবে ফিরে আসে। নিজের সাধারণ জ্ঞানকে অপমানিত না করে কেউ কি বলতে পারেন যে সেই শরীরের ভিতরে তখনও রোগ বর্তমান আছে? তথাপি প্রাচীনপন্থি প্রধান হিউফল্যান্ড দাবি করেন, ‘হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় লক্ষণসমূহ অপসারিত হলেও রোগ থেকে যায়। (Vide HOmoopathie, p. 27, 1, 19)। তাঁর এই ধারণার মূলে একদিকে আছে- হোমিওপ্যাথির দ্বারা মানবকল্যাণ সাধনে অগ্রগতি দেখে তাঁর বিদ্বেষ, অন্যদিক আছে- রোগ সম্বন্ধে তাঁর সম্পূর্ণ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। রোগ দেহগত একটি অবস্থা। গতিশীল প্রভাবে জৈবশক্তি বিকৃত হলেই রুগ্নতা প্রকাশ পায়। কিন্তু এটা ধারণা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, ব্যাধিকে তিনি একটি জড়বস্তুবাদী ব্যাপার বলে মনে করেন। তাই আরোগ্যভাবে পরেও শরীরের ভিতরে কোথাও তা গুপ্তভাবে থাকতে পারে এবং পরিপূর্ণ সুস্থতা উপভোগ করবার সময়েও তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে ধারণা করেন। পুরাতন নিদান শাস্ত্রের এখনও কি মারাত্মক অন্ধতা! এটার মাধ্যমে যে চিকিৎসা-পদ্ধতির সৃষ্টি হয় তার দ্বারা শুধু যে অসহায় রোগীর সর্বনাশই সাধিত হবে- তাতে বিস্ময়ের কিছুই নেই।

৯। জীবনীশক্তির প্রভাবে দেহ গতিশীল থাকে ও বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে ঐক্যবিধান সম্ভব হয়।      
জৈবশক্তি (Vital Force)
(৯-১০ সূত্র)
মানুষের সুস্থাবস্থায় এই বস্তুগত দেহকে (শরীর-যন্ত্রকে) যে শক্তি বাঁচিয়ে রাখে তাকে ভৌতিক (স্বয়ংচালিত - Autocracy)* জৈবশক্তি বলে। তা অসীম প্রভাবে দেহকে পরিচালিত করে। সেটা অনুভূতি ও কার্যকারিতায় দেহযন্ত্রর যাবতীয় অংশকে সুন্দররূপে ও সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রত করে। তার ফলেই অনুসন্ধিৎসু, যুক্তিবাদী মানুষ এই জীবন্ত, সুস্থ শরীরযন্ত্রকে মানবজীবনের মহত্তর উদ্দেশ্য-সাধেনে স্বাধীনভাবে নিযুক্ত করতে সমর্থ হয়।

* autocracy বা স্বয়ংচালিত কথাটি ১৫ সূত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি। যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মতও নয়। না-বোধক (negative) জীবন-বিরোধী সত্তার সাথে দ্বন্দ্ব ছাড়া হাঁ-বোধক (positive) প্রাণসত্তার অীস্তত্ব কি করে সম্ভব? যে কোন বস্তু বা ঘটনার মতোই জৈবশক্তিও দ্বৈত সত্তামন্ডিত। সুতরাং একেও আপেক্ষিক অর্থে ধরতে হবে। একইভাবে জৈবশক্তি বা প্রাণশক্তি দেহকে পরিচালিত করে; প্রাণশক্তি থেকেই জীবনের সর্বপ্রকার অনুভূতি ও কার্যকলাপ উদ্ভুত হয়; প্রাণশক্তি বা জৈবশক্তির বিকৃতিকেই রোগ বলে - কথা গুলোও আপেক্ষিক অর্থে বুঝতে হবে। অন্যথায় বিজ্ঞান সম্মত হবে না।– অনুবাদক
১০। এই আত্মারূপী জীবনীশক্তি ব্যতীত দেহ মৃত।        
১০
জৈবশক্তি ব্যতীত জড় দেহ অনুভব করতে, কাজ করতে বা আত্মরক্ষা করতে (পাদটীকা-৬ দেখুন) পারে না। একমাত্র এই অশরীরী সত্তা (জৈবনিক মূলনীতি) হতেই জীবনের সর্বপ্রকার অনুভূতি ও কার্যকলাপ উদ্ভুত হয়। সুস্থ এবং অসুস্থ- উভয় অবস্থাতে এটাই এই জড় শরীরযন্ত্রকে সঞ্জীবিত রাখে।

পাদটীকাঃ ৬। এটা তখন মৃত এবং এই মৃত অবস্থায় জীবদেহ কেবলমাত্র বাহিরের ভৌতিক ব্যাপারের নিয়মাধীন হয়ে পড়ে এবং পুনরায় তার রাসায়নিক উপাদানসমূহ বিশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। (অনুবাদক ডাঃ জে.এন. কাঞ্জিলাল)।


১১।রোগ হলে জীবনীশক্তি বিকৃত লক্ষণসমূহ প্রকাশ করে।
রোগকি?
(What is Disease?)
(১১-১৬ সূত্র)
১১
সমগ্র শরীর-যন্ত্রে বিরাজমান এই অশীরীরী, স্বয়ংক্রিয় (automatic)* জৈবনিক শক্তি কোন জীবন-বিরোধী রোগজনক রূপান্তর সাধক পদার্থের গতিশীল* প্রভাবে (dynamic influence) মৌলিকভাবে বিশৃঙ্খলা গ্রস্থ হলেই কেবল কোন ব্যক্তি রুগ্ন হতে পারে। এই জৈব মূলনীতি (vital principle) অস্বাভাবিকভাবে  বিকৃত হলে শরীর-যন্ত্রে কষ্টকর অনুভূতিসমূহের সৃষ্টি করে এবং রকমারী অনিয়মিত ক্রিয়াকলাপের জন্ম দেয়। এটাকেই আমরা রোগ বলে অভিহিত করি। এটা অদৃশ্য শক্তি বিশেষ বলে শরীর-যন্ত্রের উপর ক্রিয়া প্রকাশের ফলে এটাকে জানা যায়। শরীরযন্ত্রের যে সকল অংশে অনুভূতি ও ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে রোগ প্রকাশিত হয় কেবলমাত্র তার দ্বারাই রোগ নিজেকে ব্যক্ত করে। তা পর্যবেক্ষক ও চিকিৎসকের ইন্দ্রিয়গোচর হয়। অর্থাৎ রুগ্নতাজ্ঞাপক বিকৃতি তথা লক্ষণাবলী ছাড়া অন্য কোন উপায়ে তা জানা যায় না। (পাদটীকা-৭ দেখুন)
পাদটীকাঃ ৭। গতিশীল প্রভাব (dynamic influence),  গতিশীল শক্তি (dynamic power) কি?
আমাদের পৃথিবী আটাশ দিন কয়েক ঘন্টায় একটি গুপ্ত অদৃশ্যশক্তির প্রভাবে চন্দ্রকে তার চারিদিকে ঘুরায়। চন্দ্রও আবার ঠিক নির্দিষ্ট সময় পর পর (পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়ের পার্থক্য বাদ দিয়ে) আমাদের উত্তর সাগরে পর্যায়ক্রমে জোয়ার ভাটা ঘটিয়ে থাকে। চ্স্পষ্টতঃই এটা কোন যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে না, মানব শ্রমজাত দ্রব্যাদির মতো কোন যান্ত্রিক কৌশল মারফৎ ও ঘটেনাচ্। (অনুবাদক- ডাঃ জে. এন. কাঞ্জিলাল)। আমরা আমাদের চারিদিকেই অসংখ্য ব্যাপারে দেখতে পাই, কার্য-কারণের বোধগম্য সম্বন্ধ ছাড়াও একটি বস্তু অন্য একটি বস্তুর উপর ক্রিয়া প্রকাশ করবার ফলেই ঘটে থাকে। সংস্কৃতনামা, আরোহ অবরোহ পদ্ধতি বিচারশীল ব্যক্তিই কেবলমাত্র অতীন্দ্রিয় ধারণার অধিকারী হয়ে স্বীয় চিন্তাধারাকে জড় ও যান্ত্রিক-বস্তুবাদের উর্দ্ধে স্থাপন করতে সমর্থ হন। এইসব ঘটনাকে তিনি গতিশীল ও অব্যক্ত (dynamic, virtual) বলে মনে করেন, অর্থাৎ একটি বস্তু অন্য একটি বস্তুর উপর অনিয়ন্ত্রিত, সুনির্দিষ্ট, অবিকৃত শক্তি ও ক্রিয়াজনিত বলেই গণ্য করেন।*
      দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যেতে পারে, সুস্থ্ মানবদেহে রোগ-সৃষ্টিকারী গতিশীল প্রভাব এবং স্বাস্থ্যকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করবার জন্য প্রাণধর্মের উপর ঔষধের গতিশীল শক্তির প্রভাব বাস্তবিকপক্ষে একটি সংক্রমণ প্রক্রিয়া। সেইজন্য তা কখনও জড় বা যান্ত্রিক হতে পারে না, যেমন একটি চুম্বকের দ্বারা এক টুকরা লৌহ বা ইস্পাতকে আকর্ষণ করবার শক্তি কখনও জড় বা যান্ত্রিক নয়। চুম্বকের একপ্রান্ত লোহার টুকরাকে আকর্ষণ করবার জন্য চুম্বকের অদৃশ-শক্তিকে হুক বা লিভারের মতো কোন যান্ত্রিক (বস্তুগত) সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। নিজের শক্তিতেই চুম্বক আকর্ষণ করে। লোহা বা ইস্পাতের কাঁটার উপর চুম্বকের প্রক্রিয়া প্রকৃত প্রস্তাবে অশরীরী, অদৃশ্য, ধারণাপ্রসূত, সহজাত শক্তি সঞ্জাত। এক কথায় তা গতিশীলভাবেই (dynamically) সংঘটিত হয়। ইস্পাতের কাঁটাতে চুম্বকত্ব সঞ্চারণও অদৃশ্যভাবেই (গতিশীল ভাবেই) হয়ে থাকে। চুম্বক হতে দূরে থাকলে এবং চুম্বক স্পর্শ না করেও ইস্পাতের কাঁটাতে চুম্বকত্ব লাভ করে। আবার সেই কাঁটাটি অন্যান্য ইস্পাতের কাঁটার মধ্যে একই চুম্বকধর্ম সঞ্চারিত করে (গতিশীলভাবে)। অনুরূপভাবেই বসন্ত বা হাম রোগীকে স্পর্শ না করেও নিকটবর্তী একটি সুস্থ শিশুকে অদৃশ্যভাবে সেই ব্যাধি সংক্রামিত করে (গতিশীলভাবে)। দূরে থাকা সত্বেও এবং রুগ্ন শিশুর শরীর হতে রোগের কোন বস্তুগত উপাদান প্রবেশ না করলেও** যেকোন শিশু আক্রান্ত হয় বা হতে পারে। একটি চুম্বক যেমন নিকটবর্তী কাঁটার ভিতরে চুম্বকত্ব সঞ্চারিত করে, তেমনি একটি নির্দিষ্ট ধারণাপ্রসূত প্রভাব বসন্ত বা হাম রোগ সংক্রামিত করে।

      অনুরূপভাবেই জীবন্ত মানুষের উপর ঔষধের ক্রিয়া আমাদের বিবেচনা করতে হবে। স্বীয় নির্দিষ্ট শক্তি দ্বারা বস্তু সমূহ যখন গতিশীল, ধারণাপ্রসূত জীবননিয়ন্ত্রণকারী প্রাণধর্মের উপর ক্রিয়া প্রকাশের দ্বারা সুস্থ-মানুষকে অনুভূতিবাহী স্নায়ুমন্ডলীর মাধ্যমে গতিশীল ও ধারণাপ্রসূত প্রভাবে স্বাস্থ্যচ্যুত করতে সক্ষম হয় কেবলমাত্র তখনই বস্তুরাজী ঔষধ হিসাবে পরিগণিত হতে পারে। যে সকল জড়পদার্থের ভেষজ- ধর্ম স্বীয়-শক্তিতে জীব-স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম কেবল তাদেরই আমরা ঔষধ বলে আখ্যায়িত করি। এই ধারণাপ্রসূত জীবন-ধর্মের (principle of life)  উপরই কেবলমাত্র ঔষধের স্বাস্থ্য পরিবর্তনকারী ধারণাপ্রসূত (গতিশীল)*** প্রভাব নির্ভরশীল। চুম্বকপ্রাপ্ত নিকটবর্তী ইস্পাতের মধ্যে তার চুম্বক শক্তিকেই (এক ধরনের সংক্রমণের দ্বার) কেবল সঞ্চারিত করতে পারে। কিন্তু তার অন্যান্য গুণ (যেমন- অধিকতর কাঠিন্য বা নমনীয়তা প্রভৃতি) সঞ্চারিত করতে পারে না। এই ভাবেই প্রতিটি নির্দিষ্ট ঔষধ এক ধরনের সংক্রমণের দ্বারা পরিবর্তন সাধন করে। অর্থাৎ অন্যান্য ঔষধ হতে স্বতন্ত্র নিজস্ব এক বিশেষ প্রক্রিয়ার দ্বারা মানব- স্বাস্থ্যে নিশ্চিত পরিবর্তন ঘটায়। যেমন- বসন্ত রোগগ্রস্ত শিশুর বৈকট্য সুস্থ শিশুর শরীরে বসন্ত রোগই সংক্রামিত করে না। এই সকল ঔষধও বস্তুগত অংশসমূহ (material parts) একেবারে সঞ্চারিত না করেই আমাদের স্বাস্থের উপর সংক্রমণ- প্রক্রিয়ার মতো গতিশীলভাবে (dynamically) কার্যকর হয়। গণিতজ্ঞের চিন্তা ও ধারণা বহির্ভূত স্বল্প বস্তুভাগ থাকা সত্বেও উত্তমরূপে শক্তিকৃত ঔষধের একটি ক্ষুদ্রমাত্রায়- সেই একই ঔষধের বৃহৎমাত্রা অপেক্ষা অনেক বেশি আরোগ্যকারী শক্তি বিকশিত হয়। সেই ক্ষুদ্রমাত্রাতে কেবলমাত্র বিশুদ্ধ ও স্বাধীনভাবে বিকশিত, ধারণাপ্রসূত ভেষজশক্তিই প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিহিত থাকে। এই শক্তি কেবল গতিশীলভাবে এমন কার্যকর হয় যে, স্থূল ভেষজ পদার্থের বৃহৎ মাত্রায় কখনই তা বিকশিত হতে পারে না।

এইসব উচ্চতম শক্তিকৃত ঔষধের জড়-পরমাণু সমূহের  (corporeal atoms) মধ্যে, অথবা তাদের বস্তুগত বা গাণিতিক পর্যায়ে  যেখানে শক্তিকৃত ঔষধের উচ্চতর শক্তিসমূহের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করা হয়, কিন্তু তখনও পর্যন্ত উক্ত ঔষধ যথেষ্ট বস্তুপূর্ণ থাকে) ভেষজ শক্তির সন্ধান পাওয়া যায় না। অধিকন্ত ভিজা বড়ি (globule) বা তার দ্রবণের (solution) মধ্যে ভেষজপদার্থের অনাবৃত, মুক্ত, বিশিষ্ট ভেষজ-শক্তি নিহিত থাকে। জীবন্ত প্রাণীর তন্তুর সংস্পর্শে আসিয়া সমগ্র শরীর-যন্ত্রের উপর গতিশীলভাবে (dynamically) কার্যকর হয় (উচ্চতম শক্তিকৃত হওয়া সত্বেও তা বস্তুগত কিছুই সঞ্চারিত করে না)। শক্তিসঞ্চারণ (dynamization) পদ্ধতি অনুসারে সেই শক্তিকে যতেবেশী মুক্ত ও অশরীরী করা হবে তার কার্যকারিতাও ততবেশি জোরালো হবে।

      বিশিষ্ট চিন্তাশীল ব্যক্তির দ্বারা সমৃদ্ধ এই যুগে আমরা যখন, কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না এমন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ঘটনাসমূহ (phenomena) প্রতিনিয়ত দেখতে পাই, তখন গতিশলী শক্তিকে (dynamic energy) অশরীরী বলে ধারণা করা কি একেবারে অসম্ভব? বমন কারক ‘কোন বস্তু’ পাকস্থলীতে প্রবেশ না করলেও বমন-উদ্রেক-কারক কিছু দেখিলেই বমি হয়। এখানে কি বমন-কারক কোন বস্তু পাকস্থলীতে গিয়া বমি সৃষ্টি করেছিল? কল্পনা-জগতে বমন-কারক দৃশ্যের একটি গতিশীল প্রতিক্রিয়াই (dynamic effect) কি এটার কারণ নয়? চাক্ষুষ কোন যন্ত্রের বস্তুগত সহায়তা নিয়েই কি কেউ তাঁর বাহুকে উপরে তোলেন? কোন ভার উত্তোলনকারী দন্ডের বস্তুগত সহায়তা নিয়েই কি কেউ তাঁরা বাহুকে উপরে তোলেন? কোন ভার উত্তোলনকারী দন্ডের (lever) সাহায্য কি এখানে লওয়া হয়েছিল। কেবলমাত্র ইচ্ছাশক্তির ধারণাপ্রসূত গতিশীল প্রতিক্রিয়ার ফলেই কি তা উঠে না?

১২।জীবনীশক্তি বিকৃত হলে যেমন শরীর ও মনে অস্বাভাবিক লক্ষণসমষ্টি দ্বারা অভ্যন্তরীণ বিকৃতি প্রকাশ করে; তেমনই অস্বাভাবিক লক্ষণসমষ্টি ঔষধ দ্বারা দূরীভুত হলে জীবনীশক্তির বিকৃতি দূরীভূত হয় ও সর্বাঙ্গীণ স্বাস্থ্য ফিরে আসে।  
১২
রোগ-উৎপাদিকা শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলে জীবনীশক্তি নিজেই রোগ (পাদটীকা-৮ দেখুন) উৎপাদন করে। তাই রোগজনিত যে সব বিকৃতি আমাদের কাছে ধরা পড়ে, তারা একযোগেই সমস্ত আভ্যন্তরীক পরিবর্তন গুলিও প্রকাশ করে। অর্থাৎ আভ্যন্তরীক শক্তির সমস্ত বিকৃতিই প্রদর্শন করে; এক কথায়- সমস্ত রোগটিকেই প্রকাশ করে। সুতরাং চিকিৎসার পর সমস্ত বিকৃত ঘটনাবলীর বা সুস্থ্য অবস্থা হতে অসুস্থ্যতা প্রকাশক পরিবর্তন গুলি চলে গেলে জীবনীশক্তিকে এবং সমস্ত দেহযন্ত্রকে পূনরায় সুস্থ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। সুতরাং সমস্ত শরীরযন্ত্রে স্বাস্থ্য আবার প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাদটীকাঃ ৮। জৈবনিক শক্তি কি করে শরীরযন্ত্রে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রুগ্ন-অবস্থাদি সৃষ্টি করে, অর্থাৎ এটা কেমন করে রোগ উৎপাদন করে? ব্যবহারিক ক্ষেত্রে চিকিৎসকের তা জানবার কোন প্রয়োজন নেই। চিরকালই তা অজ্ঞাত থাকবে।* রোগ সম্বন্ধে এবং আরোগ্য সাধন করবার জন্য যা জানা একান্ত দরকার জীবননিয়ন্তা তা চিকিৎসকের বোধগম্য করে প্রকাশ করেছেন।

* জীবন্ত শরীরযন্ত্রে কি করে রোগ সৃষ্টি হয় তাও জানা ও বুঝার প্রয়োজন আছে, চিরকাল কোনও কিছু অজ্ঞাত থাকে না। কাজেই জানার জন্য সংগ্রাম ও প্রচেষ্টা দরকার।- অনুবাদক

১৩।যে সকল রোগ প্রকৃতই অস্ত্রোপচারের যোগ্য নয়, সেই সকল রোগকে শরীর ও জীবনীশক্তি থেকে পৃথক- মানবদেহে প্রবিষ্ট কোন বস্তু বলে কল্পনা করা জড়বুদ্ধির কাজ। এই জাতীয় কল্পনাই এলোপ্যাথিকে এক দারুন হানিকর চিকিৎসা প্রথায় পরিণত করেছে।
১৩
অতএব যে সকল রোগ অস্ত্রের দ্বারা চিকিৎসা করা যায় না, সেই সকল রোগকে শরীর ও জীবনীশক্তি থেকে পৃথক- মানবদেহে লুকায়িত কোন বস্তু বলে এলোপ্যাথরা যতই সূস্থভাবে মনে করেন না কেন, তা যুক্তিসিদ্ধ নয়। এই জাতীয় ধারণা জড়বাদীদের (যারা প্রাণ বা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না) মনে স্থান পায় এবং এই জাতীয় ধারণা হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত চিকিৎসাশাস্ত্রকে বিভিন্নভাবে মদদ যুগিয়ে এই (এলোপ্যাথি) চিকিৎসাশাস্ত্রকে একটি অনিষ্টকর (অনারোগ্যকর) কলাবিদ্যায় পরিণত করেছে।

১৪।মানবদেহের অভ্যন্তরে রুগ্ন এমন কিছু এবং রোগজ এমন কোন পরিবর্তন থাকতে পারে না যা সাধ্য বা আরোগ্যযোগ্য অথচ পর্যবেক্ষণশীল চিকিৎসকের নিকট ধরা পড়ে না।                                 
১৪
মানবদেহের ভিতরে এমন কোন বিকৃতি বা রোগজনিত অদৃশ্য পরিবর্তন থাকতে পারে না যা চিকিৎসায় আরোগ্যসাধ্য, অথচ তার বিকশিত বা অবিকশিত লক্ষণসমূহ সূক্ষদর্শী চিকিৎসকের নিকট আত্মপ্রকাশ করে না। এই বিধান হচ্ছে মানুষের পালনকর্তার/রক্ষাকর্তার, সর্বজ্ঞ শ্রষ্টার অসীম করুণার নিদর্শন স্বরূপ।

১৫।জীবনীশক্তির অসুস্থতা এবং প্রকাশিত লক্ষণসমষ্টি অভিন্ন বা একই।                                              
১৫
মানুষের শরীরে জীবনীশক্তি যে সূক্ষ আকারে বিরাজ করছে সেটাই মানুষকে সু্স্থ ও সজীব রাখে। সেই শক্তি বিকৃত হলে অসুস্থতা দেখা দেয়। এই অসুস্থতা (জীবনীশক্তির) এবং জীবনীশক্তি কর্তৃক উৎপাদিত বর্তমান রোগসূচক বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শারীরিক লণসমূহ মিলে একটি পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। তারা এক ও অভিন্ন। আমাদের জীবন পরিচালনার জন্য স্থূল যন্ত্র হল শরীর। কিন্তু আমাদের শরীরে যে বোধশক্তি ও পরিচালনা শক্তি আছে তা জীবনীশক্তির সজীবতা ছাড়া কখনই ধারণা করা যায় না। জীবনীশক্তিকেও তেমনি স্থূল শরীর হতে পৃথক করা যায় না। সুতরাং তারা উভয়ে মিলে একত্বপ্রাপ্ত হয়। বুঝবার সুবিধার জন্যই আমাদের মন চিন্তাকালে এই একককে দুইটি ভিন্ন জিনিস  (জীবনীশক্তি ও স্থূল দেহ) বলে আলাদা করে রাখে।

১৬। রোগ উৎপাদক সূক্ষ শক্তি দ্বারাই আমাদের জীবনীশক্তি বিকৃত হয় এবং ঔষধের সূক্ষ শক্তি দ্বারাই তা আরোগ্যপ্রাপ্ত হয়।
       
১৬
যে সকল বাহ্যিক বিরোধী শক্তি জীবনের ঐকতানকে ব্যাহত করে সুস্থ দেহযন্ত্রকে বিকৃত করে দেয়, তারা অশরীরী (গতিশীল) উপায়ে ছাড়া [spirit-like (dynamic) way]  অন্য কোন উপায়ে অশরীরী জৈবশক্তিকে (spirit-like dynamis) আক্রমণ করতে, অথবা ক্ষতিকর প্রভাবে অবিভূত করতে পারে না। অনুরূপভাবে রোগসূচক বিকৃতিসমূহেক (ব্যাধিসমূহকে) অশরীরী (গতিশীল [পাদটীকা-৯ দেখুন], অব্যক্ত) বিকল্প শক্তি (alternative powers) ছাড়া অন্য কোন উপায়েই চিকিৎসক আরোগ্য করতে সক্ষম হবেন না। সুনির্বাচিত ঔষধের বিকল্প শক্তিই আমাদের আশরীরী জৈবশক্তির উপর ক্রিয়াশীল হয়। দেহের সর্বত্র বিরাজমান অনুভূতিবাহী স্নায়ুমন্ডলীর মাধ্যমে উহারা বোধগম্যভাবে কার্যকর হয়। কাজেই জৈবশক্তির উপর গতিশীল কার্যকারিতার দ্বারা ঔষধসমূহ আরোগ্যবিধান করে ও যথাযথ ঐকতান সৃষ্টি করে। সতর্ক পর্যবেক্ষণশীল ও অনুসন্ধিৎসু চিকিৎসকের নিকট রোগী স্বাস্থ্যের বোধগম্য পরিবর্তনসমূহ (লক্ষণসমষি) আবশ্যকীয় পূর্ণাঙ্গ রোগী-চিত্র হিসাবে প্রতিভাত হয়ে উঠে এবং তদ্দারা তিনি আরোগ্য বিধান করতে সমর্থ হন।

পাদটীকাঃ ৯। কল্পনার দ্বারা জৈবশক্তি অত্যন্ত বিপর্যস্ত হলে সাংঘাতিক ব্যাধির সৃষ্টি হতে পারে এবং অনুরূপভাবেই তা নিরাময় হতে পারে।
                      
১৭। কিভাবে রোগ্য আরোগ্য করতে হয়ঃ চিকিৎসকের কর্তব্য রোগের লক্ষণসমষ্টিকে দূরীভূত করা; তাহলে সমগ্র রোগটিই দূরীভূত হয়।

কিরূপ ব্যাধি নিরাময় করতে হয়
(How to Remove Diseases)
(১৭-২৩ সূত্র)
১৭
সুতরাং রোগের সর্বপ্রকার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য লক্ষণসমূহকে অপসারণ করা হইল রোগের কারণ প্রাণ-ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিকৃতি অর্থাৎ সমগ্র ব্যাধিটিও একই সময়ে অপসারিত হয় (পাদটীকা-১০ দেখুন)। এটা হতেই বুঝতে পারা যায় যে, লক্ষণসমষ্টিকে অপসারণ করাই চিকিৎসকের কর্তব্য। অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনসমূহকে অর্থাৎ জৈবশক্তির রুগ্ন অবস্থাকে, এককথায় সমগ্র রুগ্ন অবস্থাকে (পাদটীকা-১১ দেখুন) নিরাকৃত ও নির্মূল করতে হবে। রোগ নিমূল হলেই স্বাস্থ্য পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাই চিকিৎসা বিজ্ঞানীর উচ্চতম ও একমাত্র লক্ষ্য। পান্ডিত্যপূর্ণ শব্দঝংকার নয় পরন্তু রুগ্ন-মানবজতিকে সহযোগিতা করবার মাধ্যমেই এই লক্ষ্য অর্জিত হয়।

পাদটীকাঃ ১০। ভীতিপূর্ণ স্বপ্ন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন কল্পনা, ভাবগম্ভীর ভবিষ্যৎবাণী, যেমন- কোন নির্দিষ্ট দিনে বা সময়ে মৃত্যু ঘটিবে প্রভৃতি, প্রায় সময়ে ব্যাধির সর্বপ্রকার লক্ষণের সৃষ্টি করে এবং রোগ বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, মৃত্যু নিকটতর হয়, এমনকি, সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। অভ্যন্তরীণ অবস্থার যুগপৎ (বাহ্যিকভাবে বোধগম্য অবস্থার অনুরূপ) পরিবর্তন না হলে এইরূপ কখনও ঘটতে পারে না। সেই জন্যই এই সকল রোগীর ক্ষেত্রে আসন্ন মৃত্যু নির্দেশক সর্বপ্রকার রুগ্ন-বিকৃতি একইভাবে, যেমন- কোন চতুর ছলনার দ্বারা, অথবা কোন বিপরীত বিশ্বাসে প্ররোচিত করেই নিরাময় করা হয়েছে। তাতে স্বাস্থ্যও সহসা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই নৈতিক সহায়তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক রোগজ বিকৃতিকে অপসারিত করা ও আসন্ন মৃত্যুকে রোধ করা কখনও সম্ভবপর হত না।

পাদটীকাঃ ১১। কেবল এইভাবেই মানব-রক্ষক পরমেশ্বর মানুষ যে সকল রোগভোগ করে তাদের আরোগ্য সাধন করত রোগীকে নির্মল আরোগ্য করে স্বাস্থ্য পুনরায় ফিরিয়ে আনবার জন্য কি সরাতে হবে, তা চিকিৎসককে দেখিয়ে দিয়ে তাঁর জ্ঞান ও করুণা প্রকাশ করেছেন। ব্যাধির আরোগ্যদানকারী তন্তুকে তিনি যদি রহস্যের আবরণে আবৃত রাখতেন (প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে অনুমান করা হয় যে পদার্থের অন্তর প্রকৃতিতে একটি অতি প্রাকৃতিক ব্যাপার আছে) এবং অদৃশ্য অভ্যন্তরে আবদ্ধ রাখতেন তবে সঠিকভাবে রোগকে আয়ত্ত এবং আরোগ্য করা মানবের পক্ষে কখনই সম্ভবপর হত না। তা হলে আমরা তাঁর জ্ঞান ও করুণা সম্বন্ধে কি ভাবিতাম?

১৮।লক্ষণসমষ্টিই ঔষধ নির্বাচনের একমাত্র পথপ্রদর্শক বা পরিচালক। 
১৮
আনুষঙ্গিক হ্রাস-বৃদ্ধি (৫ম সূত্র) এবং রোগের-লক্ষণ-সমষ্টি ছাড়া চিকিৎসার পথ-নির্দেশক আর কিছু কোন প্রকারেই জানা যায় না- এটা অবিসম্বাদিত সত্য। এই সত্য হতে নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে প্রতিটি রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষণ-সমষ্টি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাসমূহ ঔষধ নির্বাচনের একমাত্র পরিচায়ক ও পথ প্রদর্শক।

১৯।ঔষধসমূহের স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের বিকৃতি উৎপাদন করার ক্ষমতা আছে বলেই তা দ্বারা রোগজনিত শারিরিক ও মানসিক বিকৃতিসমূহও দূর করা যায়, অন্যথায় সম্ভব হত না।
১৯
সুতরাং, রুগ্ন লক্ষণরাজীর দ্বারা বিকশিত সুস্থ ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার পরিবর্তনই রোগ। আর রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠিত হইবার নামই সুস্থতা।* অতএব এটা স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হতেছে যে, অনুভূতি ও ক্রিয়া প্রকাশের দ্বারা দৈহিক অবস্থা পরিবর্তনের শক্তি না থাকলে ঔষধরাজী কখনই রোগ আরোগ্য করতে সমর্থ হত না। প্রকৃত প্রস্তাবে, মানব স্বাস্থ পরিবর্তন সাধনের ক্ষমতার মধ্যে ঔষধের একমাত্র আরোগ্যকর শক্তি নিহিত।

*অসুস্থতা-সুস্থতার এ সংজ্ঞা অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত।- অনুবাদক

২০।ঔষধসমূহের যে মানবস্বাস্থ্যের পরিবর্তন করার শক্তি আছে তা কেবল সুস্থ মানুষের উপর ঔষধ পরীক্ষার দ্বারাই জানা যায়।          
২০
ঔষধরাজীর আন্তর প্রকৃতিতে মানব স্বাস্থ পরিবর্তন করবার অশরীরী শক্তি (spirit like power) নিহিত না থাকলে কেবল যুক্তিবিচারের দ্বারা আমরা কখনই তা জানতে পারতাম না। মানব স্বাস্থ্যর উপর ঔষধের দৃশ্যমান কার্যকারিতার ফলে আমরা শুধু অভিজ্ঞতার সাহায্যে সম্যকরূপে তা উপলীব্ধ করতে সক্ষম হয়েছি।

২১।ঔষধ সুস্থ্য মানবদেহের যে সকল পরিবর্তন বা লক্ষণ উৎপাদন করতে পারে, কেবল সেই লক্ষণগুলিই তার আরোগ্যকারী শক্তির পরিচয় বহন করে।    
২১
ঔষধের আরোগ্যকর উপাদান আপনা-আপনি উপলব্ধি করা যায় না, এই কথা অনস্বীকার্য। সুক্ষদর্শী পর্যবেক্ষকগণের যথার্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা জানা গেছে যে মানব স্বাস্থ্যর বিশেষতঃ সুস্থ্য মানব স্বাস্থ্যের স্পষ্ট পরিবর্তন সাধন করে  নাই এরূপ  নির্দিষ্ট রুগ্ন লক্ষণরাজী সৃষ্টি করে বলেই এরা ঔষধ বা আরোগ্যকর উপাদান হিসাবে পরিগণিত হয়। তা হতেই বুঝা যায় যে, সুস্থ্য মানবদেহে ঔষধ-জাত বিশেষ বিশেষ লক্ষণসমূহই ঔষধের আরোগ্যকর চরিত্রের একমাত্র পরিচয়। কাজেই সুস্থ্য মানবশরীরে ঔষধ সৃষ্ট রুগ্নতাই ঔষধের অন্তর্নিতিহ আরোগ্যকর শক্তির একমাত্র সম্ভাব্য নিদর্শন বলেই আমাদের নির্ভর করতে হবে। তাতেই আমরা প্রতিটি ঔষধের রোগ সৃষ্টিকারী ও রোগ আরোগ্যকর শক্তি সম্বন্ধে যুগপৎ জ্ঞানলাভে সমর্থ হই।

২২।অভিজ্ঞতা দ্বারা যদি দেখা যায় যে, সমলক্ষণ অনুসারে ঔষধ প্রয়োগ করলে রোগ নিশ্চিতরূপে, স্থায়ীভাবে দূরীভূত হয়, তবে আমরা রোগ দূর করার জন্য সমলক্ষণ সম্পন্ন ঔষধই (হোমিওপ্যাথি) নির্বাচন করবো। কিন্তু যদি দেখা যায় যে, অসম বা বিপরীত লক্ষণে ঔষধ প্রয়োগে রোগটি নিশ্চিতরূপে এবং স্থায়ীভাবে দূরীভূত হয়, তবে আমরা বিপরীত লক্ষণসম্পন্ন ঔষধই (এলোপ্যাথি) নির্বাচন করবো। 
২২
(অসুস্থতাকে- অনুঃ) সুস্থতায় পরিবর্তিত করবার জন্য রোগের লক্ষণ-সমষ্টিকে অপসারণ করা ছাড়া আর কিছুই লক্ষ্য করতে হয় না। অনুরূপভাবেই সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করা এবং অসুস্থ্য' মানুষকে সুস্থ করা ছাড়া ঔষধের কার্যকারিতা সম্বন্ধে আর কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না। সুতরাং একদিকে দেখা যায় ঔষধরাজী সুনির্দিষ্ট ফলাফল ও লক্ষণরাজী (effects and symptoms) সৃষ্টি করে, অর্থাৎ কোন কৃত্রিম রুগ্ন অবস্থা উৎপন্ন করে পূর্ব হতে অবস্থিত স্বাভাবিক রুগ্ন লক্ষণসমূহকে অপসারিত ও নির্মূল করে আমাদের অকাঙ্খিত আরোগ্য সম্পাদন করে। অন্যদিক সেই রুগ্ন লক্ষণসমষ্টি নিরাময় করবার জন্য এমন একটি ঔষধ নির্বাচন করতে হয় যার (আমাদের অভিজ্ঞতায় সহজে, নিশ্চিত ও স্থায়িভাবে সদৃশ বা বি-সদৃশ ঔষধজ লক্ষণের প্রভাবে রুগ্ন লক্ষণরাজীকে নিরাকৃত করে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠিত করে সদৃশ বা বি-সদৃশ লক্ষণ সৃষ্টি করবার অত্যধিক প্রবণতা প্রমাণিত হয়েছে।

পাদটীকাঃ ১২। এই দুইটি পদ্ধতি ছাড়া রুগ্ন মানবজাতিকে ঔষধ প্রয়োগের অন্য একটি সম্ভাব্য পদ্ধতি আছে, তা হচ্ছে অ্যালোপ্যাথি। এই প্রথায় যেভাবে ঔষধ প্রয়োগ করা হয় তাতে লক্ষণরাজীর সাথে রুগ্ন অবস্থার নিদান শাস্ত্রসম্মত (Pathological) সদৃশ বা বি-সদৃশ সাক্ষাৎ কোন সম্বন্ধই দৃষ্টিগোচর হয় না।  তা বরং রোগ লক্ষণ অপেক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির (heterogeneous)। এই পদ্ধতিতে বিপজ্জনক ও উগ্র প্রকৃতির ঔষধের দ্বারা যেভাবে চিকিৎসা করা হয় তাতে একটি দায়িত্বহীন প্রাণঘাতী লীলা সংঘটিত হয়, অন্যত্র এই কথা আমি উল্লেখ করেছি। কারণ,  সেইসব ঔষধের ক্রিয়া অজ্ঞাত এবং কেবলমাত্র অনুমানের উপর নির্ভর করেই স্থূলমাত্রায় ঘন ঘন প্রয়োগ করা হয়। অন্যদিকে বমন বা মল নিঃসারণ, লালা বা ঘাম নিঃসৃত-করণ, বিশেষতঃ অপূরণীয় রক্তের অপচয় সাধন করা প্রভৃতি কষ্টকর প্রণালী অনুসণের ফলে রোগীর ব্যাধি এক অঙ্গ হতে অন্য অঙ্গে পরিচালিত হয় এবং বল ও জীবনের পক্ষে অত্যাবশ্যকীয় শক্তি ও জৈব রসসমূহ (strength and vital juices) আহরণ করে নেওয়া হয়। এই সমস্তই অন্ধ ও নিষ্ঠুর বাঁধাধরা চিকিৎসা, অথচ রোগীকে আরোগ্যলাভের আশ্বাস প্রদান করা হয়। এইগুলি যে কত অযৌক্তিক তা বিবেচনা করা হয় না। মানব শরীরের অভ্যন্তরে অবস্থিত স্বভাবজাত অবোধ জৈবশক্তি (instinctive unintelligent vital energy) যতদিন সুস্থ থাকে ততদিন মানবদেহকে ছন্দোবদ্ধভাবে পরিপুষ্ট করে সুস্থ জবিনযাপনে সহায়তা করে। কিন্তু রোগের কবল হতে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। সুতরাং, জৈবশক্তিকে বারংবার অন্ধভাবে অনুকরণ করা ক্রটিপূর্ণ ও একেবারে অসংগত। জৈবশক্তির সর্বময় কতৃত্ব থাকলেও সে কখনও শরীর-যন্ত্রকে রুগ্ন হতে দিত না। অনিষ্টকর উপাদানের দ্বারা জৈবশক্তি যখন পীড়িত হয়, তখন শরীরের স্বাভাবিক গতিতে বিকৃতি আসার ফলে জৈবশক্তি একটি ক্লান্তি প্রকাশ করে মাত্র। তখনকার সৃষ্ট লক্ষণরাজীই বিবেকী চিকিৎসককে সাহায্য দিবার জন্য ইঙ্গিত করে। যদি সাহায্য দেওয়া না হয় তা হলে রোগটি বাড়াইয়া, বিশেষতঃ বেশী পরিমাণে  নিঃস্রাব ঘটিয়ে তার ফলে ক্ষতি স্বীকার করে, এমনকি জীবনের বিনিময়েও জৈবশক্তি আত্মরক্ষা করতে তৎপর হয়।

      রুগ্নতায় অবসাদগ্রস্ত জৈবশক্তি এতই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, আরোগ্যসাধানের জন্য তাকে অনুকরণ করবার কোন প্রয়োজন হয় না। কারণ, তখন উহার দ্বারা প্রকাশিত সকল বিকৃতি ও লক্ষণসমূহই রোগ-চিত্র হিসাবে বিবেচিত হয়। আরোগ্য সাধনের জন্য কোন বুদ্ধিমান চিকিৎসক কি এটাকে (জৈবশক্তিকে- অনুঃ) অনুকরণ করবেন? এইভাবে কি রোগীর জীবন বলি দিতে চাইবেন?

২৩। বিপরীত লক্ষণসম্পন্ন ঔষধসহযোগে চিকিৎসায় (এলোপ্যাথিক চিকিৎসায়) স্থিতিশীল ব্যাধি আরোগ্য হয় না, বরং কিছুকাল স্থগিত থেকে পূনরায় অধিক বেগে আবির্ভূত হয়। 
২৩
সর্বপ্রকার যথার্থ অভিজ্ঞতা ও সমস্ত রকমের নির্ভুল গবেষণা আমাদের সন্দেহাতীত ভাবে জানিয়ে দেয় যে, রোগের বদ্ধমূল লক্ষণসমূহ ঔষধের বিপরীত লক্ষণসমূহের দ্বারা (অ্যান্টিপ্যাথিক-antipathic,, ইনেন্টিওপ্যাথিক- enantiopathic  বা প্যালিয়েটিভ- Palliative পদ্ধতির দ্বারা) কিছুতেই অপসারিত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে না। পক্ষান্তরে আপাত উপশমের অনতিকাল পরেই এরা আবার আরও ভীষণভাবে প্রকাশিত হয় এবং বৃদ্ধি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে (৫৮-৬২ ও ৬৯ সূত্র দেখুন)
চলবে...........

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.